‘প্রিতমকে হত্যা করেছে মিডল্যান্ড’


কুমিলা মহানগরীর রামঘাটস্থ মিডল্যান্ড হাসপাতালের চরম অবহেলায় মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভত ফরাসী নাগরিক এক শিশুর। তার নাম প্রিতম আলম অন্তু (৬)। সর্বোচ্চ আধাঘন্টা সময়ে যে ‘ইলেক্ট্রোলাইট’ রিপোর্ট দেয়া সম্ভব তা দিতে অন্তত ৬ঘন্টা সময় নেয়ায় এবং চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহত প্রিতমের অভিভাবকরা। প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ দেখতে এসেছিলো ফ্রান্সে জন্ম নেয়া ঐ শিশু। প্রিতম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ও প্যারিস থেকে প্রকাশিত পাকি প্রবাস বাংলা পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক অপু আলম এবং মা ওই পত্রিকার প্রকাশক নাজিয়া আলমের ছেলে। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার সদর দণি উপজেলার বাগমারা মনোহরপুর গ্রামে।
অধ্যাপক আলমগীর হোসেন অপু জানান, ঈদ করতে এবং দেশে থেকে যাওয়ার চিন্তা থেকে গত ২২ জুন স্ত্রী নাজিয়া আলম পারভিন, বড় ছেলে ফাহিম আলম ও ছোট ছেলে প্রিতম আলমকে নিয়ে দেশে আসি। ফ্রান্সেই ফাহিম ও প্রিতমের জন্ম।  জ্বর ও কয়েকবার বমি হওয়ায় শুক্রবার সকাল ৯টায় প্রিতমকে কুমিলা নগরীর রামঘাটস্থ মিডল্যান্ড হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মো: আজিজুল হোসেন শিশু প্রিতমকে দেখে টাইফয়েড হয়েছে বলে হাসপাতালে ভর্তি দেন। সেই সাথে ব্লাড ও ইলেক্ট্রোলাইট টেস্ট ও বুকের এক্সরে পরীক্ষা করতে দেন। দায়িত্বরত চিকিৎসকের পরামর্শে প্রিতমের প্যাথলজিক্যাল পরীা সকাল ১০টায় করা হলেও এর রিপোর্ট দেয়া হয় সন্ধ্যা ৬ টায়। রিপোর্টে চিকিৎসক প্রিতমের শরীরে পটাশিয়ামের শূণ্যতা উল্লেখ করে তা এক দশমিক নয় বলে উল্লেখ করা হয়। মুর্মূষু অবস্থায় শিশুটিকে রেখে চিকিৎসক বাসায় চলে যান। বিকাল ৬টার দিকে চিকিৎসক এসে রিপোর্ট দেখে তাকে দ্রুত ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। পরে প্রিতমকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত সোয়া ১১টায় সেখানকার ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
‘প্রিতমকে হত্যা করেছে মিডল্যান্ড’
প্রিতমের বাবা অপু আলম জানান, আমার ছেলের অবস্থা গুরুতর দেখেই তো চিকিৎসক ইলেক্ট্রোলাইট টেস্ট দেন। এ রিপোর্ট দিতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট লাগার কথা। সে রিপোর্ট দেয়া হয় ৬ ঘন্টারও বেশি সময় পরে। এর মধ্যে আমার ছেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অথচ রিপোর্ট যথাসময়ে পেলে তখন তাকে পটাশিয়াম ফোরাইড দিয়ে পটাশিয়ামের সমতা আনার চেষ্টা করা যেতো। যখন দেখেছে ছেলের অবস্থা করুন তখন বলেছে ঢাকায় নিতে। আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়ার জন্য নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়ালোজি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. জয়দীপ দত্ত গুপ্তের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ইলেক্ট্রোলাইট রিপোর্ট দিতে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগবে। এই সময়ে বেশি সময় লাগার কোন কারন নেই। রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে দ্রুত সময়ে চিকিৎসা করতে এ রিপোর্ট নিতে হয়।
তিনি জানান, ইলেক্ট্রোলাইট রিপোর্ট যে মেশিনে করা হয় তা কখনো বন্ধ করা হয় না। পুরো ল্যাব বন্ধ করা হলেও ঐ মেশিন চালু থাকে।
মিডল্যান্ড হাসপাতালের চিকিৎসক ও কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মো: আজিজুল হোসেন জানান, শিশুটিকে তিনি পান শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। তিনি চেম্বারে আসলে শিশুটিকে প্রথমে আনা হয়। তার লিভার বড় এবং টাইফয়েড হয়েছে বলে তাকে ভর্তি দেই এবং অবস্থা গুরুতর বলে তিনটি পরীক্ষা করতে বলি। ব্লাড ও লবনের পরীক্ষা এবং বুকের এক্সরে। শিশুটির মেটাবলিক ডিজিজ বা রোগ প্রতিরোধ করার সমস্যা ছিল। শিশুটিতে ৩০৩ নম্বর কক্ষে ভর্তি করা হয়।
তিনি বলেন, আমি যাওয়ার সময় পৌণে ১টায় দেখেছি শিশুটির বাবাকে ল্যাবে। এরপর আমি জুম্মার নামাজে চলে যাই।  বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেই। আসরের নামাজ পড়ে এবং চা খেয়ে নিজেই শিশুটিকে দেখতে সোয়া ৫টার দিকে আসি। আমি আসার সাথে সাথে রিপোর্টও আসে। তখন দেখি পটাশিয়াম ‘এক দশমিক নয়’। সাথে সাথে তাকে ঢাকা নেয়ার জন্য পরামর্শ নেই।
তিনি জানান, পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট দিতে তো সময় লাগে। টেকনিক্যাল ব্যাপার। রিপোর্ট দিতে খুব বেশি দেরি হয় নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যদি নিজে না আসতাম তাহলে আমাকে কল দিয়ে আনা হতো। শুক্রবার তো আসারও কথা না।
তিনি আরো জানান, শিশুটির দুই আত্মীয় আমাকে বলেছে আমি সকালে কেন ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ নেই নি। আমি বলেছি কোন রিপোর্ট না পেলে আমি কিভাবে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেবো। বিকালে আমি এসে রিপোর্ট পেয়েছি তখন তো পটাশিয়াম ফোরাইড দিতে বলি। আমি নিজে স্যালাইনে পটাশিয়াম ফোরাইড দিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিই। পরে রাতে তারা ফোন করে বলেছে শিশুটি মারা গেছে।
প্রিতমের বাবা অপু আলম জানান, ঢাকায় নেয়ার সময় যে স্যালাইন দেয়া হয় তা মাঝ পথেই শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসক সেটা বিবেচনায় নেন নি যে যেতে যেতে স্যালাইন শেষ হয়ে গেলে আরেকটা দিতে হবে। তিনি সে ব্যবস্থাও করেন নি। বলা যায় মৃত্যুর মুখের প্রিতমকে দিয়ে দেন তিনি।
এ বিষয়ে  কুমিলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান জানান, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছি। কেউ অভিযোগ না করলেও যেহেতু শিশু মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে সেহেতু আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মৃত্যুর প্রকৃত কারন জেনে ব্যবস্থা নেব।
কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জ্বর ও বমির কারন হাইপোকেলিমিয়া। এধরনের রোগীর ইলেক্ট্রোলাইট রিপোর্ট অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকে করা হয়। আর এটি করা হয় রোগী অবস্থা যখন গুরুতর এবং দ্রুত চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে তখন। রিপোর্টটি সাথে সাথে নিয়ে চিকিৎসকের উচিত ছিল তার পটাশিয়াম ব্যালেন্স করা। কিন্তু যথা সময়ে রিপোর্ট না পাওয়ায় বা গাফিলতিতে ঐ ৫/৬ ঘন্টায় শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
একজন চিকিৎসক বলেন, যখন রিপোর্টে পাওয়া গেল এক দশমিক নয়। তখন তাকে স্থানান্তর করাও ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ সে সময় তাই করা হয়েছে।
এ দিকে অবহেলায় প্রিতম আলমের মৃত্যুর খবর ফেসবুকে এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ এর প্রতিকার চেয়ে নানা মন্তব্য করে।
শনিবার বেলা আড়াইটার কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বাগমারা মনোহরপুরে নিজবাড়িতে প্রিতম আলমের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এ সময় কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আলহাজ মো: ওমর ফারুক, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাবলু, উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষ অংশ নেন।

Comments

Posts

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা

সুখ